উপরের টাইটেলটি পড়ার পর নিশ্চয়ই সবার মনেই অনেক প্রশ্ন উঁকিঝুকি মারছে। এই আমি টা আবার কে? এই প্রশ্নটি দ্বারা কাকে বোঝানো হচ্ছে? কোনো ছেলে না মেয়ে নাকি অন্য কাউকে? অথবা আমি কার এই প্রশ্নটিই বা কেন উঠছে?
অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ আছে এই প্রশ্নটি করার পেছনে। এই গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হচ্ছে আমার মন। আমার মনের ভিতর ঘুরে বেড়ানো কিছু প্রশ্ন আর জমে থাকা অনেক কথার উপর ভিত্তি করেই এই প্রশ্ন। অনেকরই মনে হতে পারে আমার মনের কথা বা প্রশ্ন সবার জন্য কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ? এ প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হবার কারণ হচ্ছে এই আমি টা যে শুধুমাত্র আমি তাতো নয়। এই আমি টি হচ্ছে সকল মেয়ে জাতি। বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশ ও মুসলিম সমাজের সকল মেয়ে জাতির প্রতি আমার এই লেখাটি উৎসর্গীকৃত।
" অস্তিত্ব " খুব ভারী একটি শব্দ। অস্তিত্ব বলতে আমরা কী বুঝি? কোনো কিছুর উপস্থিতি বা কারো সত্তা। এই অস্তিত্ব এমন একটি জিনিস যা কেউ জানুক বা না জানুক, কেউ বুঝতে পারুক বা নাই পারুক তাতে কারো অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সেটি শুধুমাত্র আক্ষরিক অর্থে। এই সমাজে মেয়েদের অস্তিত্ব শুধুমাত্র আক্ষরিক অর্থেই বিদ্যমান। কারণ জন্মের পর তার পরিচয় কারোর মেয়ে হিসেবে। এরপর তার পরিচয় সে কারোর বোন। বিয়ের পর তার পরিচয় বদলে সে কারোর স্ত্রী ও কারোর বাড়ির বউ হয়ে উঠে। তারপর আসে মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে সুখের পরিচয় , সেটি হচ্ছে তার সন্তানের মা হয়ে উঠা। এরপর সে হয়ে উঠে কারোর শ্বাশুড়ী এবং জীবনের সর্বশেষ পরিচয় হলো কারো দাদী বা নানী হয়ে উঠা। সবার এখন মনে হবে এতে সমস্যা টা কোথায়? ছেলেদের জীবনেও তো এই সম্পর্ক গুলো আসে। হুম আসে কিন্তু এইখানেও অনেক বড় একটা পার্থক্য আছে। সেটি হচ্ছে মেয়েরা সবসময় পরিচিত হয় ছেলেদের পরিচয়ে কিন্তু ছেলেরা কিন্তু সবসময় নিজস্ব পরিচয়েই পরিচিত। আমার কাছে যেটিকে সবচেয়ে বেশি কষ্টদায়ক মনে হয় সেটি হচ্ছে জন্মের পর থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত মেয়েদের ঠিকানা তার বাপের বাড়ি। বিয়ের পর থেকে তার ঠিকানা শ্বশুরবাড়ি বা স্বামীর বাড়ি। কিছু ক্ষেত্রে তার শেষ বয়সের ঠিকানা তার ছেলের বাড়ি। কিন্তু এতো কিছুর ভীরে মেয়েটির পুরো জীবন কালে নিজের ঠিকানা কোনটি? মেয়েটির নিজের বাড়ি কোনটি? একটা সময় পর্যন্ত মেয়েটির পরিচয় অমুকের মেয়ে এরপর অমুকের স্ত্রী মা দাদী নানী কিন্তু মেয়েটির নিজস্ব পরিচিতি টি কোথায়? এমনকি মেয়েরা যদি বাবা মায়ের নাম উজ্জ্বল করে, বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করে তখনও মানুষ প্রশংসা করার জন্য বলে থাকে- আপনার মেয়েই তো আপনার ছেলের মতোই। মেয়ে হয়ে ছেলের দায়িত্ব পালন করছে। এমন মেয়ে থাকলে আর ছেলের দরকার হয় না।
কিন্তু কেন এই প্রশংসা করার ক্ষেত্রে ও ছেলেকে উদাহরণস্বরূপ ব্যবহার করতে হবে? বাবা মা ছেলেকে পেলে বড় করলে মেয়েকেও তো লালন পালন করেছেন। একটি মেয়ে কেন মেয়ের মতো মেয়ে হয়ে প্রশংসা পেতে পারে না? ভালো কিছু করলে কেন সেটি ছেলের মতো দায়িত্ব পালনের কথা উঠে? ছেলেদের যেমন অভিভাবকদের প্রতি দায়িত্ব আছে মেয়েদের কী সেটি নেই?
কষ্টকর সাথে মজাদার একটি প্রচলিত কথা আছে। মৃত্যুর পর চোখের পানি ফেলার জন্য হলেও নাকি মানুষ মেয়ে সন্তান কামনা করে। তাহলে কী মেয়েদের ভূমিকা শুধুমাত্র এই চোখের পানি ফেলার পর্যন্তই ? গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা এখানে কিন্তু বাড়িকে সম্পত্তি এর রূপে বোঝানো হচ্ছে না। এই শব্দটিকে আমি শুধুমাত্র অধিকারের ঘাটতি বোঝানোর জন্য ব্যবহার করছি। আমি শুধুমাত্র এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছি একটি মেয়ের জীবনে নিজস্ব সত্তা বলতে কিছুই নেই। এজন্যই হয়তোবা মেয়েদের পরের ধন বা অন্যের আমানত বলা হয়।
এমনকি মেয়েদের নিজের জীবনের প্রতি কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলেও হয় তার বাবা না হয় তার স্বামীর অনুমতি নিতে হয়। যেটি ছেলেদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেন এই বৈষ্ণমতা? নিজেদের যোগ্যতা থাকার পরও কেন অন্যের অনুমতির আশায় বসে থাকতে হবে?
কাউকেই কষ্ট দেয়া কিন্তু আমার উদ্দেশ্য নয়। শুধুমাত্র মেয়ে জাতির নিজস্ব পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইছি। আসলে সে কার? তার বাবার? স্বামীর? সন্তানের? না সে নিজের? সেকি কখনোই তার নিজস্ব পরিচয়ে পরিচিতি পেতে পারে না? সেকি নিজেই একটি আলাদা সত্তা হিসেবে সমাজের চোখে পরিচিতি পেতে পারে না?
আমার মনের এই প্রশ্নগুলো আপনাদের মাঝে ছরিয়ে দিলাম। আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি কিন্তু আশা করি আপনাদের মধ্যে কারো পক্ষে সম্ভব হবে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া। সাথে এটিও আশা করি মেয়েরাও একদিন এই পুরুষ সমাজের ভীরে নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পাবে এবং সেটি তারা নিজেদের যোগ্যতায় অর্জন করবে।