যেকোনো শিশুর জন্ম পরবর্তী সর্বপ্রথম খাদ্য হচ্ছে তার মায়ের বুকের দুধ। স্তন্যপান শিশু ও তার মায়ের মধ্যে অত্যন্ত ভালোবাসা ও নির্ভরশীলতার বন্ধন গড়ে তোলে। শুধু তাই নয়, স্তন্যপান করা এবং করানো দুটিই সমান জরুরি। শিশুর জন্য তার মায়ের দুধ অমৃতের মতো।
মায়ের বুকের দুধ শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মায়ের দুধে শিশুর প্রয়োজনীয় সব ধরনের পুষ্টি উপাদান থাকে। এছাড়া মায়ের দুধে শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ পানি থাকে। ফলে শিশুকে প্রথম ৬মাস বা ১৮০দিন পর্যন্ত আলাদা করে কোনো পানি খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই।
☆ মায়ের দুধের কার্যকারিতা -
মায়ের দুধ শিশুর জীবনধারন ও বৃদ্ধির জন্য সুষম খাদ্য। জন্মের পর যতো দ্রুত সম্ভব শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। মায়ের দুধের অ্যান্টিবডি শিশুর প্রথম টিকা হিসেবে কাজ করে। শিশুর দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দ্রুত কার্যকর করে তোলে। শিশুকে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসনালির রোগ, হাঁপানি, অ্যালার্জি প্রভৃতি রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখে। মায়ের দুধে পূর্ণমাত্রায় ভিটামিন 'এ' থাকে, ফলে তা শিশুর অস্থি রোগ 'রিকেট' হওয়া থেকে প্রতিরোধ করে। এছাড়া শিশু অসুস্থ হলেও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়। মায়ের দুধ পান শিশু মৃত্যুর হারও কমিয়ে দেয়। পরবর্তীতে শিশুর ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি ভয়াবহ রোগ হবার সম্ভাবনা অনেকাংশ কমে যায়।
শিশুর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশেও মায়ের দুধের কার্যকর ভূমিকা রয়েছে। দীর্ঘদিনের গবেষণায় দেখা গেছে, যেসকল শিশু গুঁড়া দুধ খায় তাদের তুলনায় যারা মায়ের দুধ খায় তাদের বুদ্ধির বিকাশ তুলনামূলকভাবে বেশি। প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদান থাকার ফলে এটি শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
☆ শিশুর সর্বপ্রথম টিকা-
শিশুর জন্মের পর মায়ের বুকে প্রথম যে দুধ আসে তাকে শালদুধ বলে। শালদুধ শিশুর জীবনের প্রথম টিকা হিসেবে কাজ করে। এ দুধ ঘন, আঁঠালো এবং একটু হলদে রঙের হয়। প্রসবের পর প্রথম ২-৩ দিন যতটুকু শালদুধ আসে তা একটি নবজাতকের জন্য যথেষ্ট।
অনেকেই শিশু জন্মের পরপরই মুখে মধু, চিনি বা পানি দিয়ে থাকেন। কিন্তু এটি নবজাতক শিশুর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই শিশু জন্মের পর শালদুধ ছাড়া আর অন্যকিছু দেয়া যাবে না। এসব দিলে পাতলা পায়খানা হবার সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে শিশুর বুকের দুধ খাওয়ার আগ্রহ কমে যায়।
শালদুধ আমিষ সমৃদ্ধ এবং এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন 'এ' আছে। এতে আছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। শালদুধ শিশুর পেট পরিষ্কার করে এবং নিয়মিত পায়খানা হতে সাহায্য করে। ফলে নবজাতকদের জন্ডিস হবার সম্ভাবনা কমে যায়।
☆ বুকের দুধ মা ও শিশু উভয়ের জন্যই উপকারী -
বুকের দুধ খেলে শুধুমাত্র যে শিশুর উপকার হয় তা কিন্তু নয়। বুকের দুধ খাওয়ালে মায়েদেরও উপকার হয়। চলুন এই সম্পর্কে জেনে আসা যাক।
◆ মায়ের উপকার-
▪ জন্মের পরপরই শিশুকে বুকের দুধ দিলে মায়ের প্রসবজনিত রক্তপাত বন্ধ হয়। পরবর্তীতে রক্তস্বল্পতা হয় না। গর্ভজনিত স্ফীত জরায়ু দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
▪ যেসকল মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান তাদের স্তন, জরায়ু এবং ডিম্বকোষের ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা থাকে না।
▪ বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং শিশুর সাথে আত্মিক বন্ধন দৃঢ় হয়।
▪মায়ের দুধ নিরাপদ, ঝামেলামুক্ত। মায়ের বাড়তি খাটুনি ও সময় বাঁচায়। সাথে অর্থের সাশ্রয় হয়।
◆ শিশুর উপকার-
▪ মায়ের দুধে শিশুর প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদান সঠিক মাত্রায় থাকে। ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে আলাদা করে পানি দেবারও কোনো প্রয়োজন নেই।
▪ বুকের দুধ পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত। বায়ু বা পানিবাহিত জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা থাকে না।
▪ মায়ের দুধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকার ফলে শিশু অসুস্থ হলেও দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়।
▪ মায়ের দুধ সহজে হজম হয়। প্রাথমিক অবস্থায় শিশুর দেহ জটিল খাবার হজম করতে পারে না। কিন্তু মায়ের দুধের উপাদান সহজে হজম হয়।
▪ মায়ের দুধে পূর্ণমাত্রায় ভিটামিন 'এ' থাকার ফলে শিশুর রাতকানা হবার সম্ভাবনা থাকে না।
▪ পরবর্তীকালে শিশুর ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি ভয়াবহ রোগ হবার সম্ভাবনা কমে যায়।
▪ শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মায়ের দুধ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসকল শিশু কৌটার দুধ খায় তাদের তুলনায় মায়ের দুধ পান করা শিশুদের মানসিক বুদ্ধি তুলনামূলকভাবে অধিক।
▪ মায়ের বুকের দুধ শিশু মৃত্যুহার কমায়।
জন্মের পর থেকে ছয়মাস বয়স পর্যন্ত একটি শিশুর জন্য শুধুমাত্র মায়ের দুধই যথেষ্ট। এরপর শিশুরা সাধারণত অন্যান্য খাবারের সাথে দুই বৎসর পর্যন্ত মায়ের দুধ খেয়ে থাকে। এই মায়ের বুকের দুধ শিশুদের কাছে অমৃতের মতো এবং শিশুদের জন্য এটি উপযুক্ত সুষম খাদ্য। তাই প্রতিটি শিশুকে অবশ্যই অন্তত এক থেকে দেড় বছর পর্যন্ত বুকের দুধ পান করানো অত্যন্ত জরুরী।